Blog Details

Blog Thumbnail

টাঙ্গুয়ার হাওর: জলের দেশ, নীরবতার গল্প

 

শহরের ব্যস্ততা, ধোঁয়ায় ভরা আকাশ, আর একঘেয়ে জীবনের ক্লান্তি থেকে কিছুটা মুক্তি খুঁজে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা অজানার পথে, যেখানে সময় থেমে থাকে, আর প্রকৃতি নিজেই হয়ে ওঠে গল্পের নায়ক। গন্তব্য ছিল টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের বুকে বিস্তৃত এক অপার্থিব জলরাজ্য, যার সৌন্দর্য বোঝাতে শব্দ অনেক সময় অপ্রতুল হয়ে পড়ে।

সকালবেলা সুনামগঞ্জে পৌঁছেই এক ধরনের অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করলাম। শহর এখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, আমরা সকালে বাস থেকে নেমে সামান্য ফ্রেশ হয়ীকতা অটো নিয়ে চলে যাই আমাদের বোট ঘাটের দিকে। হাওরের বুক যেন নিঃশব্দে আমাদের ডাকছিল। রাস্তা ধরে যেতে যেতে একসময় চোখের সামনে খুলে গেল সেই জলের বিস্তার। চারদিকে শুধু জল, আর সেই জলে ছায়া ফেলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছ, দূরে নৌকার ছায়া, আর আকাশের মেঘেরা যেন পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে।

নৌকায় উঠতেই মনে হলো, আমরা যেন আর বাস্তব দুনিয়ায় নেই। চারপাশের নীরবতা এতটাই গভীর, যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যায়। বাতাসে এক ধরনের ভিজে গন্ধ, তাতে কাদার মিশ্র ঘ্রাণ, আবার কোথাও কোথাও বৃষ্টির পর পাতার ওপর জমে থাকা জলের সুবাস। আমরা খাবার খেতে খেতে আমাদের বোট ছেড়ে দিলো। 

পাখিরা আমাদের সঙ্গী হয়ে যায় কিছুটা পথ। কেউ কেউ আকাশে ঘুরে বেড়ায়, আবার কেউ হাওরের জলে নামতে নামতে পাখনার ছটায় জলের ওপর তুলির টান দেয়। গাছের ডালে বসে থাকা সাদা বক যেন নীরব দর্শক, আমাদের এই জলযাত্রার।

পাড়ের ছোট ছোট গ্রামগুলো যেন জলেই জন্ম নিয়েছে। বাঁশ আর কাঠের ঘর, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুদের চোখে একধরনের অদ্ভুত কৌতূহল। তারা জানে না “ট্যুরিজম” শব্দের মানে, কিন্তু তারা জানে এই হাওরই তাদের পৃথিবী।

নৌকার মাঝখানে বসে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় মনে হলো, এর চেয়ে সেরা কোন রেস্টুরেন্ট হতে পারে না। হাওরের টাটকা মাছ, ভাত, আর প্রকৃতির সঙ্গ এটি ছিল এক প্রাকৃতিক ভোজ, যার স্বাদ শহরের কোনো স্বাদে পাওয়া যায় না।

বিকেলে হাওরের রঙ বদলায়। সূর্য যখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে, তখন পুরো জলরাশি যেন আগুনে রঙ ধারণ করে। সে এক জাদুকরি মুহূর্ত আকাশ, জল, আর আমাদের হৃদয়, সবকিছুই একসময় একাকার হয়ে যায়।

রাত নেমে এলে হাওর আরও নীরব হয়। দূরের কোনো গ্রামে বাঁশির সুর ভেসে আসে হালকা বাতাসে। জোনাকির আলো, আর আকাশভরা তারা যেন এক স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়েছি। 

- উমর সালেহ।